লিয়াকত হোসেন খোকন
আমার বাড়িতে কত ঘণ্টা করে লক্ষ্মীপূজা হয়। ছবির মহরকে কালীবাড়ি, আনুষ্ঠানিক পূজো- স্বন্ত্যোন উৎসব। এসব বড় সুন্দর প্রথা, বড় চমৎকার ট্যাডিশন। একে যদি ঈশ্বর বা ঠাকুর দেবতা মানা বলেন, তবে মানি বৈকি ? কিন্তু আসলে ঈশ্বর! না আমি জানি না তিনি আছেন কি নেই , তবে একটা কন্ট্রোলিং পাওয়ার একটা নিয়ন্ত্রী শক্তিকে বিশ্বাস করি। শুনলে হাসবেন, তবু বলি, প্রতিদিন নিয়ম করে পুজোর ঘরে একা বসি।
[একটু থেমে একটা সিগারেট ধরিয়ে সামান্য ইতস্তত করে বললেন]
মিসেস সেনও বসেন।
– কোন মিসেস কেন?
– সুচিত্রা সেন। উনি প্রতিদিন অনেকটা সময় পূজোর ঘরে কাটান।
– ছোটবেলা বন্ধু-বান্ধব খুব ভালো লাগত। কিন্তু এখন একা থাকার মত ভালো আর কিছুতেই লাগে না।
একটা ব্যাপার আমার স্বভাবতই কম। সেটা উচ্ছাসের বহিঃপ্রকাশ। কেউ বলেও খুব একটা সাদর আহবান জানাতে পারি না। কেউ চলে গেলেও বুক খালি হয়ে যায় না।
[ঠোঁট ওল্টালেন] কি করব বলুন? যা হয় না, আসে না তা দেখাই কি করে?
– নাঃ, আর কোনো কিছুই রাখিনা। কোনো কিছু প্রিয়, আপন, খুব আদরের, দারুন কোনো স্মৃতির কোনো স্যুভেনির। এমন কি বাবা-মায়ের কোনো ছবিও না। আমার সম্পত্তি আর আমার নয়। এবং আমি কোনো ডায়েরিও রাখি না।
– এককালে ডিরেকটররা আমার আশা ছেড়ে দিয়েছিলেন। আমাকে তাঁরা বলতেন ফ্লপ মাস্টার জেনারেল। ধরুন সেই ১৯৪৭ -এর ‘মায়াডোর’ (সে ছবি রিলিজই হয়নি) থেকে আরম্ভ করে ১৯৫২ সালের ‘সঞ্জীবনী’ পর্যন্ত । এই সুদীর্ঘ ছয় বছর ধরে আমি ফিল্ম লাইনের সব রকম অপমান সহ্য করেছি। যেমন ধরুন কন্ট্রাকট সই করতে যাচ্ছি। প্রযোজক হাত থেকে কনট্রাক্ট ছিনিয়ে নিলেন। যে ছবির নায়ক হব বলে জানি, অন্য নায়ক নিয়ে তার মহরৎ হয়ে গেল। গানের জলসায় গান গাইতে গেছি, দেখি হয়ে গেছে। ডাকও পড়েনি।
– না, সাফল্য হঠাৎ হাতের মুঠোয় আসেনি। এলাম দেখলাম জয় করলাম। আমি ওই দলের লোক নই। অভাব অপমান অনিশ্চয়তার ঘষতে ঘষতে, অভিজ্ঞ হতে হতে, অভিনয় শিখতে শিখতে ১৯৫২-র শেষের দিকে বসুপরিবারে সুখেনের চরিত্র পর্যন্ত পৌঁছে যাই।
– প্রথম দিকে আমার সামনে নায়ক হিসেবে ছিলেন বিকাশদা, অসিতবরণ। এঁদের ছাড়িয়ে যেতে হবে, এমন একটা জিদ ছিল বৈকি। তবে আপনি যা বলছেন, অনেক শিল্পীর জীবনে একটা রাগ একটা প্রতিদ্বদ্বিতা কিংবা ঈর্ষা থেকে এক ধরনের সার্থকতা আসে, আমার জীবনে সে সুযোগ কোথায়? তেমন চ্যালেঞ্জ জানাবার মত লোক কই? কাউকে তো কার কাছেই দেখছি না। এ তো প্রায় ফাঁক মাঠে ক্রমাগত গোল করে যাওয়া।
– ভালো অভিনেতা হতে গেলে ভালোমত কষ্ট স্বীকার করতে হয়। এ তো খেলার মতই। মুখে বোম্বাই সুপুরি রেখেছি দিনের পর দিন। যাতে অবলীলাক্রমে দীর্ঘ সংলাপ বলে যেতে পারি। ড্রাইভিং, সুইমিং, নাচ, জুজুৎসু, জুড়ো – এসবশারীরিক ব্যাপার তো আছেই, তাছাড়া বহু রকম গভীর বিষয় জানা। একজন অভিনেতার কি উচিত নয় সাধারণ মানুষকে জানা। রোজ কাগজ পড়া। সাহিত্যের বই পড়া। রেডিও শোনা, ভালো ছবি দেখা। বিশেষ করে বিদেশী।
[যেহেতু এ শিল্পটাই বিদেশী। ওরা কন্দুর এগোলো আমাদের জানতে হবে না?]
সূত্র – আনন্দলোক।
Leave a Reply