মাজহারুল ইসলাম (রুবেল), জেলা প্রতিনিধি মাদারীপুর :
মাদারীপুর সদর হাসপাতালে ওষুধসহ অন্যান্য মালামাল সরবরাহের কাজে ব্যাপক অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে। কাগজে-কলমে সরবরাহ থাকলেও বাস্তবে তা নেই। এতে করে একদিকে জনগণ যেমন সরকারি সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে, অন্যদিকে সরকারের কোটি কোটি টাকা গচ্চা যাচ্ছে। অভিযোগ রয়েছে, মালামাল সরবরাহের কাজে মাদারীপুর সদর হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ সিন্ডিকেটের কাছে জিম্মি হওয়ার কারণেই এই পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। রোগীদের অভিযোগের ভিত্তিতে মাস ছয়েক আগেও দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) সেখানে অভিযান পরিচালনা করেছিল।
অনুসন্ধানে জানা যায়, গত পাঁচ বছর মাদারীপুর সদর হাসপাতালের মালামাল সরবরাহের কাজ পেয়েছে একই পরিবারের মালিকানাধীন দুটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। অভিযোগ রয়েছে, তাদের হাতেই জিম্মি হয়ে পড়েছে মাদারীপুর সদর হাসপাতালের মালামাল সরবরাহের কাজ। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে তিন কোটি ৩৮ লাখ ৫৫ হাজার ২০১৬ টাকার মালামাল সরবরাহের কাজ পায় মেসার্স তাসিন ইন্টারন্যাশনাল ও মিজান ট্রেডিং কো. নামে দুটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। প্রতিষ্ঠান দুটির মালিক দুই ভাই সিরাজুল আলম খান ও মিজান খান। সিরাজুল মাদারীপুর পৌরসভার কাউন্সিলর এবং স্থানীয় আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী নেতা। ২০১৯-২০ অর্থবছরে মালামাল সরবরাহ করা হয় চার কোটি ১৭ লাখ ৫৮ হাজার ১১৯ টাকার। সেইবারও ওই দুই ভাইয়ের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান মালামাল সরবারাহ করে। ২০২০-২১ অর্থবছরেও ওই দুই প্রতিষ্ঠান চার কোটি ৫৬ লাখ ৯০ হাজার ৩৫৭ টাকার মালামাল সরবরাহ করে। ২০২১-২২ অর্থবছরে মিজান ট্রেডিং কো. ছয় কোটি ৯ লাখ ৭১ হাজার ১২১ টাকার মালামাল সরবরাহ করে।
মাদারীপুর সিভিল সার্জন কার্যালয় ও হাসপাতাল সূত্রে জানা গেছে, চলতি অর্থবছরে পাঁচ কোটি ৩৭ লাখ টাকার দরপত্র আহ্বান করা হয়েছে। মাদারীপুর সদর হাসপাতালের মালামাল সরবরাহের জন্য ছয়টি প্যাকেজে দরপত্র আহ্বান করা হয়। ছয়টি প্যাকেজে ৯৮টি শিডিউল বিক্রি হয় এবং জমা পড়ে মাত্র ১৩টি শিডিউল। চলতি অর্থবছরেও সবাইকে অবাক করে কাজ পেয়ে যায় সেই দুই ভাইয়ের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান মিজান ট্রেডিং এবং তাসিন ইন্টারন্যাশনাল।
অনুসন্ধানে জানা যায়, গত অর্থবছরে গজ, ব্যান্ডেজ, তুলা ক্রয়ের জন্য বরাদ্দ ছিল ৩৪ লাখ ৯৯ হাজার ৮৬৫ টাকা। লিলেন কাপড়ের জন্য বরাদ্দ ছিল ৩৪ লাখ ৯৭ হাজার ৯৪০ টাকা। সে হিসাবে প্রতিদিন গজ, ব্যান্ডেজ, তুলা ও লিলেন কাপড়ের জন্য খরচ হয়েছে ১৯ হাজার টাকা। অথচ প্রতিদিন রোগীদের নিজ খরচেই কিনতে হয় এইসব সামগ্রী। ১০০ শয্যাবিশিষ্ট এই হাসপাতালের জন্য গত অর্থবছরে আইভি ফ্লুইড ও দন্ত চিকিৎসার উপকরণ (ওষুধ) কেনা হয়েছে এক কোটি ৯০ লাখ ৩১ হাজার ১৮৪ টাকার। অথচ সেখানে দন্ত চিকিৎসক নেই দুই বছর ধরে। দন্ত চিকিৎসক না থাকলেও বিপুল পরিমাণ অর্থ খরচ হয়েছে। এ ছাড়া অন্যান্য ওষুধ কেনা হয়েছে এক কোটি ১৩ লাখ ৭৪ হাজার ৯৭৩ টাকার।
নানা বিষয়ে অনিয়মের অভিযোগ তুলে সেবাপ্রার্থীরা দুদকে অভিযোগ দিলে গত বছরের ২৯ আগস্ট হাসপাতালটিতে অভিযান পরিচালনা করে দুদক। তখনো হাসপাতালে চিকিৎসাসেবায় অনিয়ম ও অব্যবস্থাপনার প্রমাণ পেয়েছিল দুদক। কমিশনের পক্ষ থেকে এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে সুপারিশ করেছিলেন দুদকের সমন্বিত জেলা কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক আখতারুজ্জামান।
মাদারীপুরের পাঁচখোলা গ্রাম থেকে চিকিৎসা নিতে আসা রোগী মো. রাজ্জাক বলেন, ‘আমাদের তো জ্বর আর গ্যাস্ট্রিকের ওষুধ ছাড়া সবই কিনে নিতে হয়। হাসপাতাল থেকে বলে সাপ্লাই নাই। শুনি ওষুধ কেনায় কোটি কোটি টাকা খরচ করা হয়। কিন্তু তেমন কোনো ওষুধ তো পাই না।’
চিকিৎসা নিতে আসা শহরের ইটেরপুল এলাকার বাসিন্দা মো. মাসুদুর রহমান বলেন, ‘এখানে আসলে শুধু গ্যাসের আর জ্বরের ওষুধ পাওয়া যায়। প্রায় সব ওষুধ বাইরে থেকে কিনে খেতে হয়।’
তবে সিন্ডিকেটের অভিযোগ অস্বীকার করেছেন দুই ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের মালিক। তাদের দাবি, নিয়মতান্ত্রিকভাবেই তারা মালামাল সরবরাহের কাজ করেন। কোনো ধরনের অনিয়মের সঙ্গে জড়িত নয় বলেও দাবি করেন তারা। হাসপাতালের ঠিকাদারি কাজ তারা নিয়ম অনুসারেই পেয়ে থাকেন বলে জানান।
মাদারীপুর উন্নয়ন সংগ্রাম পরিষদের সভাপতি অ্যাডভোকেট মাসুদ পারভেজ বলেন, ‘আমি যত দূর জানি, মাদারীপুর সদর হাসপাতালে যারা ওষুধ সাপ্লাইয়ের কাজ করেন তারা দুই-তিন বছর নয়, গত দুই দশক ধরেই এই হাসপাতালে ওষুধ ও অন্যান্য চিকিৎসাসামগ্রী সাপ্লাই করেন। তারা হাসপাতালের ঠিকাদারি ব্যবসার একটি শক্ত সিন্ডিকেট তৈরি করেছেন। যার জন্য সব সময়ই অনিয়মের অভিযোগ ওঠে। এখানে দ্রুত স্বচ্ছতা আনার দাবি করছি।’
এ ব্যাপারে মাদারীপুরের সিভিল সার্জন ডা. মুনীর আহমেদ বলেন, ‘মালামাল সরবরাহের কাজে অনিয়ম নেই। তবে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ এলে তদন্ত করা হবে।’ দন্ত চিকিৎসক না থাকলেও এই খাতে কোটি টাকা খরচের ব্যাপারে তিনি জানান, ওই টাকা অন্য খাতে খরচ করা হয়েছে।
লাল সবুজের দেশ
Leave a Reply